আমাদেরে জাতীয় কবি ও বিদ্রোহী কবি – কবি কাজী নজরুল ইসলাম
সূচনাঃ আমার প্রিয় কবি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম । তিনি বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে বাংলা ১৩৬৬ সনের ১১ ই জৈষ্ঠ্য ( ১৮৯১ সালের ২৫ শে মে ) এক দরিদ্র মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ।
বাল্যকালঃ তার পিতার নাম ছিল কাজী ফকির আহমদ এবং মাতার নাম ছিল জাহেদা খাতুন । মাত্র আট বছর বয়সে কবি পিতৃহীন হন । দশ বছর বয়সে তিনি গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষা পাস করেন এবং গ্রামের মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন । এরপর তিনি গ্রাম্য ‘ লেটোর ’ যোগদান করেন এবং গান ও নাটক লিখে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন । নজরুলের চাচা নজরুলকে কৌতুক করে ‘ বেঙাচি ’ ডাকতেন এবং বলতেন বড় হলে আমার বেঙাচি সাপ হবে । তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী নজরুলের জীবনে সত্যে রূপ নেয় ।
শৈশবঃ লেটোর দল ছেড়ে কবি রাণীগঞ্জের নিকটবর্তী শিয়ারশোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন । কিন্তু স্বাধীনচেতা নজরুলের স্কুলের নিয়ম – কানুন পছন্দ না হওয়ায় তিনি সেখান থেকে আসানসোলে পালিয়ে যান এবং রুটির দোকানে সেখানে অবসর পেলে -মাসিক পাঁচ টাকা বেতনে কাজ করতে থাকেন । এ সময়ে তিনি রাতে সুর করে গান গাইতেন আর পুঁথি পড়তেন । ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানা নিবাসী কাজী রফিউদ্দীন আসানসোলে দারোগা ছিলেন । তিনি নজরুলের চোখে মুখে বুদ্ধির দীপ্তি ও শিক্ষানুরক্তিদেখে তাঁকে স্ব-গ্রামে নিয়ে যান এবং কাজীর সিমলা গ্রামের হাই স্কুলে ভর্তি নজরুল শৈশবকাল থেকেই দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন । সেখান থেকে লেখাপড়া ছেড়ে তিনি স্বগ্রামে ফিরে আসেন এবং স্বেচ্ছায় শিয়ারশোল করে দেন । স্কুলে ভর্তি হয়ে কিছুদিন মন দিয়ে লেখা পড়া করেন ।
যুদ্ধযাত্রাঃ নজরুল অষ্টম শ্রেণীর চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে নবম শ্রেণীতে যখন উন্নীত হন এমন সময় প্রথম মহাযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে । নজরুল বাঙ্গালী রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে করাচী চলে যান । পল্টনে থাকাকালীন তিনি সৈনিক থেকে হাবিলদার পদে উন্নীত হন ।এই করাচি সেনানিবাসে তিনি একজন পাঞ্জাবী মৌলভী সাহেবের কাছে ফার্সী শিক্ষা করেন । তাই তাঁর সাহিত্যিক জীবনে ফার্সীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
যুদ্ধশেষেঃ নজরুল যে বাহিনীতে ছিলেন যুদ্ধ শেষে তা ভেঙ্গে দেয়া হয় । অতঃপর বাংলা ১৩২৬ সনে ( ইংরেজি ১৯১৯ সালে ) তিনি করাচী থেকে দেশে ফিরে আসেন । স্বাধীনতার জন্য তখন ভারতবর্ষে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়েছে । এ সময়ে কবির মর্মস্পর্শী সঙ্গীতে সমগ্র বাঙালী উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে । ১৯২০ সালে শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হকের সম্পাদনায় ‘ মোসলেম ভারত ‘ পত্রিক বেরোয় । তার প্রথম সংখ্যা থেকে নজরুলের ‘ বাঁধন হারা ’ পত্রোপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে । ১৩২৮ বাংলার ( ১৯২২ ইংরেজী সালের ) কার্তিক সংখ্যায় ‘ মোসলেম ভারতে নজরুলের বিখ্যাত কবিতা বিদ্রোহী ‘ ও ‘ কামাল পাশা ‘ প্রকাশিত হয়। বিদ্রোহী ’ কবিতা প্রকাশিত হবার সাথে সাথে তিনি একদিনেই সেকালের বাংলার তরুণ সমাজে প্রিয় কবি হয়ে ওঠেন । এর আগে তাঁর প্রথম কবিতা ‘ মুক্তি ’ প্রকাশিত হয় ১৯১৮ সালে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় । ”
কাব্যচর্চাঃ তিনি মোসলেম ভারত , সওগাত , প্রবাসী , কল্লোল প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে থাকেন । কবি নিজের স্বাধীন মত প্রচার অভিপ্রায়ে ‘ ধূমকেতু ’ নামে একটি বিপ্লবী অর্ধ – সাপ্তাহিক সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন । এতে প্রকাশিত ‘ আগমনী ’ নামক কবিতা এবং “ম্যায় ভুখা হু”একটি হচ্ছে নজরুল রক্তঝরা ভাষায় স্বাধীনতার বাণী শোনান। ব্রিটিশ সরকার আইনের বলে পত্রিকা বন্ধ করলেন এবং কবিকে বন্দী করে হুগলী জেলে রাখেন ।জেলে যাবার প্রাক্কালে আসামীর কাঠগড়ায় দাড়িয়ে তিনি যে জবানবন্দী’ দান করেন “রাজবন্দীর জবানবন্দী” নামে তা বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ হয়ে রয়েছে । এই কারণে জেল কর্তৃপক্ষ উপর নানাবিধ অত্যাচার করলে প্রতিবাদে নজরুল অনশন ধর্মঘট শুরু করেন।
জেলে থাকাকালীন তিনি বিপ্লব ও বিদ্রোহাত্মক রচনা করে বন্দীদের জাগিয়ে তোলেন । এ কারণে জেল । রবীন্দ্রনাথ চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখ দেশ বরেণ্য মনীষীরা পত্র ও তার যোগে নজরুলকে অনশন ত্যাগ করতে অনুরোধ জানান । অবশেষে চল্লিশ দিন পর কুমিল্লার বিরজা সুন্দরী দেবীর অনুরোধে তিনি অনশন করেন ।
কবিকীর্তি : তারুণ্যের বিজয় পতাকা হাতে নজরুলের আবির্ভাব । ” তোরা সব জয়ধ্বনি কর – ওই নতুনের কেতন ওড়ে কাল বৈশাখীর ঝড়” এই কথাগুলো কবির অতর্কিত আবির্ভাব সম্পর্কে সেদিনের বাঙালী কাব্য পাঠকেরও প্রানের বানী । কবির প্রথম যুগের কবিতায় ধ্বনিত হয়ে ওঠে বিদ্রোহ ও মুক্তির সুর । ‘ অগ্নি বীণা , ” বিষের বাণী , ” ভাঙ্গার গান . ” প্রলয় শিখা, ‘ ফণী মনসা , ‘ সর্বহারা , ” সাম্যবাদ ‘ প্রভৃতি কাব্যে অন্যায় , অবিচার , অত্যাচার প্রপীড়িত মানুষের পুঞ্জীভূত মুকহাদয় বেদনাকে তিনি অগ্নিবীণাতে স্বতোৎসারিত ছন্দ সুরে প্রকাশ করেছিলেন । স্বাধীনতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কবি তাঁর ‘ সাম্যবাদী ‘ কাব্যগ্রন্থ প্রণয়নে আত্মনিয়োগ করেন । দেশবন্ধুর মৃত্যুতে “ চিত্তনামা ‘ নামক শোকগাঁথা কাবাটি কবির এ সময় কারই রচনা ।
উপসংহার : দুরারোগ্য মানসিক ব্যাধির আক্রমণে কবি স্মৃতিশক্তি লুপ্তপ্রায় হয়ে সুদীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরকাল 1383 বাংলা 12ই ভাদ্র (1976 সালের 28শে আগষ্ট) মৃত্যু বরণ্য করেন। আমাদের জাতীয় কবি , বিদ্রোহী কবি , মানুষের কবি , কবি এবং সাম্যবাদী কবি নজরুলের বন্ধনহারা মুক্ত জীবনের এবং স্বাধীনতা উদ্বুদ্ধ সঙ্গীত বাহাঙ্গীর প্রাণে মুক্তির চেতনা এনে দেয় । ফলে এবং সাম্রাজ্যবাদীর কবল থেকে মুক্ত হবার প্রেরণা মৃত্যুর কোলে পড়েন ।
Comments (0)