বর্ষাকাল :The 2nd new season of Bangla season.
বর্ষাকাল

বর্ষাকাল এর সূচনা : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন এই বাংলাদেশ । ষড়ঋতুর লীলা খেলা এর ওপর দিয়ে পর্যায়ক্রমে প্রবাহিত হয়ে যায় । সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা নদী – কুত্তলা সাগর – মেখলার দেশ এই বাংলার এক একটি ঋতু স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন রূপ নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে যায় ।কাল বৈশাখী : প্রকৃতির রাজ্যে যখন গ্রীষ্ম প্রদাহ অগ্নিচক্ষ নিক্ষেপ করে তখন উর্ধ্ব মুখে চেয়ে চাতক বলে ওঠে – তৃষ্ণা বিদীর্ণ এই বুকে আমার জলসিঞ্চিত করে দেয় হেরূদ্র প্রকৃতি । কৃষাণের কণ্ঠে ফুটে উঠে বিষাদমথিত সুর :

‘ আল্লাহ মেঘ দে ,

পানি দে , ছায়া দেরে তুই ’ ।

সমস্ত পৃথিবী যখন গ্রীষ্মে জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে লোকেরা ত্রাহি ত্রাহি করে , ঠিক তখন গ্রীস্মের রোধানল দৃষ্টিকে বাষ্প করে :

” ঈশানের পুঞ্জ মেঘ অন্ধ বেগে ধেয়ে চলে আসে বাধা বন্ধন হারা গ্রামান্তরে ৰেনুকুঞ্জে নীলাঞ্জন হায় সঞ্চারিয়া হানে দীর্ঘধারা ।

বর্ষাকাল এর আগমনঃ , ঘনকৃষ্ণ মেঘের ডমরু বাজিয়ে উপস্থিত হয় বর্ষার রুদ্রমূর্তি । কবিগুরু বর্ষা বন্দনা করতে গিয়ে বলেছেনঃ

‘ ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে

জল সিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভ ভরসে

ঘন গৌরবে নব যৌবনা বরষা

শ্যাম গম্ভীরা সরসা । ‘

 বর্ষার আগমনে বাংলার মানুষ আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠে । কিষাণীর মুখে ফুটে ওঠে অনবদ্য হাসি । আষাঢ় যেন শুনিয়ে দেয় আশার বাণী । ঝর ঝর ঝির ঝির রবে ধারা বর্ষিত হয় অবিরাম । সজীব হয়ে ওঠে বিদগ্ধ সবুজ বনানী । পুলকিত হয়ে ওঠে কিশলয় ।

 বাংলায় ছয় ঋতুর মধ্যে বর্ষা একটি ব্যতিক্রম । পৃথিবীর সকল দেশেই অন্যান্য ঋতুগুলো রয়েছে , কেবল নেই বর্ষা । এর আবির্ভাব যেমন রাজকীয় – ~ -এর প্রকাশেও রয়েছে তেমনি বৈচিত্র্য । বর্ষাকাল নিয়ে আসে একটি স্বর্গী সৌন্দর্য।

 বর্ষাকাল সৌন্দর্য : কবি কালিদাস থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের যে কোন অখ্যাত কবি বর্ষার সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হন , বুকের ভেতরে যে না বলা বেদনা অনুভব করেন- তা বাংলার পল্লী গ্রামের বর্ষা । এই বর্ষায় মনে হয় কি যেন নেই , কি যেন দুরে সরে গেলো- এই স্বতঃস্ফুত বিরহ বেদনাবোধ যুগে যুগে কতো কবিকে কাব্যসৃজনের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে কতো অ – কবিকে ভাবান্তরিত করেছে — তার ঠিক নেই । সত্যি , এই বর্ষা মানুষের হৃদয়ের গভীরতম প্রদোষকে আন্দোলিত করে এবং এমন দিনে কার যেন নিবিড় সান্নিধ্যলাভে মানুষের মন উন্মুক্ত হয়ে থাকে । কবি বলেছেনঃ –

“এমন দিনে তারে বলা যায়

এমন ঘন ঘোর বরিষায় ।”

হৃদয় সাগর উপকূল

মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জন ও হংকার প্রতি মুহুতে প্রলয়ের চিহ্ন নয়নের সমক্ষে তুলে ধরে । মাঝে মাঝে সৌদামিনী , চকিত হাসি হেসে মেঘের কোলে অদৃশ্য হয়ে যায় । এই ঘন ঘোর বর্ষাতেই কবি গুর তার বাঞ্ছিত সুন্দরের দেখা পেয়ে বলেছেন :

“ আজি আসিয়াছে ভুবন ভরিয়া

গগনে ছড়ায়ে এলোচুল

চরণে ছড়ায়ে বনফুল

ডেকেছে আমারে তোমার ছায়ায়

যখন সজল বিশাল মায়ায়

আকুল করেছ শ্যাম সমারোহে

চরণে জড়ায়ে বনফুল ।”

 বর্ষাকালের বাংলা যেন রূপসী বাংলা । গাছে গাছে সবুজ পাতার আকুতি শাখায় শাখায় পুষ্পের সমারোহ । গ্রামের ছোট ছোট ঘরগুলো যেন সবুজ রংয়ের আড়ালে আত্মসমর্পণ করে সারা বছরের মনের কথা বলে দেয় । সারাদিন ধরে ঝুপ ঝপ বৃষ্টির শব্দ । গাছে গাছে বৃষ্টি মাখা হাওয়া আর ভিজে পাখির নাচন দেখে গ্রামের হৃদয়গুলো যেন দুলে ওঠে । এখানে ওখানে চলতি পথের দু’পাশের কামিনী , বেলী , মালতী , যুঁথি , কদম, কেতকী , কুন্দ আরো কতো নাম না জানা ফুলের মেলা । এ সময়ের ফল পেয়ারা , জাম , আনারস , কাঁঠাল এবং তরকারি ঝিঙ্গে , পুই , কুমড়া , শসা প্রভৃতি ।

বন্যা প্লাবন : মাঠে মাঠে জলের খেলা । সব দিকেই একটা প্রাণ প্রাচুর্যের পরিচয় ফুটে ওঠে । ধান শীষগুলো জলের পরশে শ্যামল হয়ে মৃদু বাতাসে দুলতে থাকে । প্লাবিত বন্যার বুকে চলে সোনার তরীর আনাগোনা এ গ্রামে সে গ্রামের দুরত্ব যেন সাত সমুদ্রের ব্যবধান । ছোট ছোট ছেলেদের কলার ভেলায় সাগর পাড়ি দেয়ার সে কি আনন্দ । ক্ষেত আর বিলে মাছ ধরার ধুম পড়ে যায় । সোনালী ধানের স্বপ্ন চোখে নিয়ে জোয়ান বৃদ্ধরাও  ছোট নৌকা চড়ে মাছ ধরতে যায়।জেলে ছেলেরা আগামী  দিনের মহড়ায় মত্ত হয় ।

বর্ষাকাল এর দুপুরের আকাশে : দুপুরের অবকাশে বারান্দার কোণায় মেয়েরা জড় হয়ে মেঘের গল্প করে , কেউবা কথা সেলাই করে বৃষ্টি ঝরা গানের সুরে হৃদয়ের অব্যক্ত সুরকে মিশিয়ে দেয় ।‘’ নারীর অন্তরের ভাবকে কবি ” চিনে বলেছেন :

কেউবা রঙ্গীন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপনখানি ।

তারে ভাষা দেয় দীঘল সুতায় মায়ারী আখর টানি ।

যুবকেরা হয়তোবা কারো দহলিজে জড় হয়ে তাস পাশা খেলায় মত্ত হয়ে থাকে । বৃদ্ধের্ শরীরটা কাঁথায় ঢেকে হুকো টানতে টানতে ধূসর চোখে আকাশের দিকে দৃষ্টি মেলে দেয় , হয়তোবা অপর পাড়ের ডাক শুনে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে । কালো মেঘের আড়ালে বিকেলের অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে , যেন কাজের ব্যস্ততার সাথে পাল্লা দিয়ে বর্ষার সন্ধ্যে ঘনীভূত হয় ।

অপকারিতাঃ সৌন্দর্য বৈচিত্র্যই কেবল বর্ষার রূপ নয় । পল্লীর লোকেরা বর্ষার জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে থাকে । কদমাক্ত রাস্তাঘাট যানবাহনের অভাবে জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে । গ্রামগুলো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো হয়ে পড়ে । শহরের সাথে সকল সম্পর্কই ছিন্ন হয়ে যায় । রোগে ওষুধের প্রয়োজনও তাদের মেটেনা । অপর দিকে অতি বর্ষ । বন্যায় এসে ক্ষেত প্লাবিত করে কৃষকের মনের সবুজ ফসলের স্বপ্নকে ধুলিসাৎ করে দিয়ে যায় । ঘরের চাল দিয়ে বৃষ্টির পানি ঝরে রাতের সুখটুকুও কেড়ে নেয় ।

উপসংহারঃ বর্ষার সৌন্দর্য এবং ফসলের সম্ভাবনার আশা পল্লীবাসীদের হাদয়কে উম্মনা করে রাখে । বছরের মাঝে একটিবার তারা জীবনকে প্রকৃতির সাথে এক সূত্রে গেঁথে দেয় । হাজারো দুঃখের সরোবরে বর্ষায় বাংলার পল্লীগ্রাম যেন একটি বৈচিত্র্যের শতদল ।